
যুদ্ধ বন্ধ করুন, খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করুন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে: বিশ্বনেতাদের প্রতি অধ্যাপক ইউনূস
বিশ্বনেতাদের প্রতি যুদ্ধ বন্ধ করে ক্ষুধা দূর করার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, প্রতি বছর বিশ্বে সামরিক ব্যয়ে ব্যয় হয় ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার, অথচ ক্ষুধা দূর করতে কয়েক বিলিয়ন ডলারও জোগাড় করা যায় না। পাশাপাশি বিদ্যমান কাঠামোর রূপান্তর ঘটিয়ে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
সোমবার (১৩ অক্টোবর) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ২০২৫ সালের ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে (ডব্লিউএফএফ) মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ক্ষুধা দূর করতে আমরা কয়েক বিলিয়ন ডলারও তুলতে পারি না, অথচ অস্ত্র কেনায় সারা বিশ্বে ব্যয় হয়েছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এটাকেই কি আমরা উন্নয়ন বলব? ক্ষুধা ও সংঘাতের দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ থামাতে হবে, সংলাপ শুরু করতে হবে এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
ছয় দফা প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করুন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার সক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করুন।’
এ সময় খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) স্থিতিশীল রাখতে আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি। এছাড়া অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তা, বিশেষত তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাণিজ্যনীতি যেন খাদ্য নিরাপত্তাকে ব্যাহত না করে, বরং সহায়তা করে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ নিশ্চিত করুন, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের, গ্রামের তরুণ-তরুণীদের জন্য।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ২০২৫ সালের ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম (ডব্লিউএফএফ) রোমে এফএও’র সদর দপ্তরে শুরু হয়েছে গত ১০ অক্টোবর, যা চলবে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত। এটি এমন একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিশ্বের নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উদ্যোক্তারা খাদ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতবিনিময় করেন।
সপ্তাহব্যাপী এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, হ্যান্ড ইন হ্যান্ড ফর বেটার ফুডস অ্যান্ড বেটার ফিউচার, অর্থাৎ উত্তম খাদ্য ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে হাতে হাত রাখা। তিনটি স্তম্ভকে কেন্দ্র করে এবারের ফোরামের আয়োজন করা হয়েছে। সেগুলো হলো: গ্লোবাল ইয়ুথ অ্যাকশন, সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন এবং হ্যান্ড-ইন-হ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ৮০ বছর পূর্তি কেবল একটি উৎসব নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির আহ্বান। এবারের প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়— খাদ্য শুধু ক্যালরির বিষয় নয়; এটি মর্যাদা ও ন্যায়ের, যেমন পৃথিবীতে আমরা বসবাসের স্বপ্ন দেখি, তার প্রতীক।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সহযোগিতায় অংশ নিতে পেরে বাংলাদেশ গর্বিত। আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোকাবিলায় বৈশ্বিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এফএও ও জি-২০-এর সঙ্গে মিলে আমরা সত্যিকারের ও কার্যকর কারিগরি, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ— তরুণ, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগ। এটি কোনো স্লোগান নয়, এগুলো হলো আমাদের খাদ্যব্যবস্থা ও সমাজকে রূপান্তর করার উপকরণ।
তিনি বলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে সম্পদ আছে, প্রযুক্তি আছে; আরও বিস্ময়কর প্রযুক্তি আসবে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আমাদের প্রয়োজন সৃজনশীল ধারণা, যথাযথ ব্যবসায়িক কাঠামোর মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব। আমরা যদি এটি কল্পনা করতে পারি, আমরা তা তৈরি করতেও পারব।’
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিতে নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে দাবিতে গত বছর বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে জেগে উঠেছিল। বুকে সাহস ও আশা নিয়ে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তাদের দাবি ছিল সরল: ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দাও; ন্যায়, অন্তর্ভুক্তি ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজ গড়ে তোলো।’
তিনি বলেন, ‘চলুন, সত্য কথাটি স্পষ্টভাবে বলি: ক্ষুধা কোনো সংকটজনিত অভাবের ফল নয়। আমরা যে অর্থনৈতিক কাঠামোর তৈরি করেছি, তার ব্যর্থতা। ২০২৪ সালে ৬৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। অথচ আমরা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খাদ্য উৎপাদন করি। অর্থাৎ, এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নৈতিক ব্যর্থতা।’
আমাদের আরও গভীরে ভাবতে হবে এবং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরনো পথ, যা কেবল মুনাফা বাড়ানো ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, তা কোটি কোটি মানুষকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। আমাদের একটি নতুন ব্যবসার ধারা প্রবর্তন করতে হবে। সেটি হচ্ছে সমাজভিত্তিক ব্যবসা, ব্যক্তিগত মুনাফাহীন ব্যবসা যা সমস্যা সৃষ্টি করে না বরং সমাধান দেয় এবং টেকসই প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন অনেক সমাজভিত্তিক ব্যবসা গড়ে উঠছে, কিন্তু নীতিগত সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া তারা এগোতে পারছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় তিন শূন্যের বিশ্ব নির্মাণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
তিন শূন্য নীতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূর করতে এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টি যেখানে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ থাকবে না (Zero Wealth Concentration), বেকারত্বহীন সমাজ সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি (Zero Unemployment) এবং এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না (Zero Net Carbon Emissions)।
পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে বৈশ্বিক অঙ্গনে বারবার আওয়াজ তোলা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটি কোনো স্বপ্ন নয়, এটি অপরিহার্য— পৃথিবীকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সমাজভিত্তিক ব্যবসা (Social Business) হচ্ছে সেই পথ। আমরা বাংলাদেশে এর শক্তি দেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে— কীভাবে দরিদ্র নারীও একজন শক্তিশালী উদ্যোক্তা হতে পারেন।’
এ সময় তরুণ উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক, কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের সহায়তায় সমাজভিত্তিক ব্যবসায়িক তহবিল গঠনের আহ্বান জানান তিনি। তার কথায়, ‘এই ধরনের উদ্যোগের পক্ষে আইনি ও আর্থিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে; বাধা নয়, সহযোগিতা করতে হবে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম। আজকের তরুণরা আগের মতো নয়— তারা সংযুক্ত, সৃজনশীল এবং তাদের এমন প্রযুক্তি হাতে রয়েছে যা ২০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।
তিনি বলেন, ‘তরুণদের চাকরি খুঁজতে বলবেন না, তাদের চাকরি সৃষ্টি করতে সক্ষম করে তুলতে হবে। চলুন তাদের বলি: তোমরা চাকরিপ্রার্থী নও, চাকরিদাতা। তাদের পুঁজিতে প্রবেশাধিকার দিন; বিনিয়োগ তহবিল ও সমাজভিত্তিক ব্যবসায়িক তহবিল গড়ে তুলুন। তাদের কৃষি উদ্ভাবনকেন্দ্র গড়ে তুলতে, কৃষি প্রযুক্তি, চক্রাকার খাদ্যব্যবস্থা ও জলবায়ু-সহনশীল প্রকল্পে উদ্যোক্তা হতে সহায়তা দিন।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা যদি তরুণদের ওপর বিনিয়োগ করি, তাহলে তারা শুধু এই বিশ্বকে খাদ্যই দেবে না, বিশ্বকে বদলে দেবে।’
সূত্র: ইউএনবি
রিপোর্ট : এটিএন নিউজ/মা.ই.স
সোমবার (১৩ অক্টোবর) জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ২০২৫ সালের ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে (ডব্লিউএফএফ) মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এ আহ্বান জানান।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘ক্ষুধা দূর করতে আমরা কয়েক বিলিয়ন ডলারও তুলতে পারি না, অথচ অস্ত্র কেনায় সারা বিশ্বে ব্যয় হয়েছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এটাকেই কি আমরা উন্নয়ন বলব? ক্ষুধা ও সংঘাতের দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ থামাতে হবে, সংলাপ শুরু করতে হবে এবং সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
ছয় দফা প্রস্তাব তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করুন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার সক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা করুন।’
এ সময় খাদ্য সরবরাহের শৃঙ্খল (সাপ্লাই চেইন) স্থিতিশীল রাখতে আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠনের প্রস্তাব দেন তিনি। এছাড়া অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোক্তা, বিশেষত তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাণিজ্যনীতি যেন খাদ্য নিরাপত্তাকে ব্যাহত না করে, বরং সহায়তা করে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ নিশ্চিত করুন, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের, গ্রামের তরুণ-তরুণীদের জন্য।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত ২০২৫ সালের ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম (ডব্লিউএফএফ) রোমে এফএও’র সদর দপ্তরে শুরু হয়েছে গত ১০ অক্টোবর, যা চলবে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত। এটি এমন একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিশ্বের নীতিনির্ধারক, গবেষক ও উদ্যোক্তারা খাদ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে মতবিনিময় করেন।
সপ্তাহব্যাপী এবারের আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, হ্যান্ড ইন হ্যান্ড ফর বেটার ফুডস অ্যান্ড বেটার ফিউচার, অর্থাৎ উত্তম খাদ্য ও সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একসঙ্গে হাতে হাত রাখা। তিনটি স্তম্ভকে কেন্দ্র করে এবারের ফোরামের আয়োজন করা হয়েছে। সেগুলো হলো: গ্লোবাল ইয়ুথ অ্যাকশন, সায়েন্স অ্যান্ড ইনোভেশন এবং হ্যান্ড-ইন-হ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ৮০ বছর পূর্তি কেবল একটি উৎসব নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির আহ্বান। এবারের প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়— খাদ্য শুধু ক্যালরির বিষয় নয়; এটি মর্যাদা ও ন্যায়ের, যেমন পৃথিবীতে আমরা বসবাসের স্বপ্ন দেখি, তার প্রতীক।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক সহযোগিতায় অংশ নিতে পেরে বাংলাদেশ গর্বিত। আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মোকাবিলায় বৈশ্বিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এফএও ও জি-২০-এর সঙ্গে মিলে আমরা সত্যিকারের ও কার্যকর কারিগরি, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ— তরুণ, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগ। এটি কোনো স্লোগান নয়, এগুলো হলো আমাদের খাদ্যব্যবস্থা ও সমাজকে রূপান্তর করার উপকরণ।
তিনি বলেন, ‘আজকের পৃথিবীতে সম্পদ আছে, প্রযুক্তি আছে; আরও বিস্ময়কর প্রযুক্তি আসবে। কিন্তু এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আমাদের প্রয়োজন সৃজনশীল ধারণা, যথাযথ ব্যবসায়িক কাঠামোর মাধ্যমে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন পৃথিবী তৈরি করা সম্ভব। আমরা যদি এটি কল্পনা করতে পারি, আমরা তা তৈরি করতেও পারব।’
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান বলেন, ‘গণতন্ত্র, শান্তি ও মানবাধিকার নিশ্চিতে নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে দাবিতে গত বছর বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে জেগে উঠেছিল। বুকে সাহস ও আশা নিয়ে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। তাদের দাবি ছিল সরল: ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দাও; ন্যায়, অন্তর্ভুক্তি ও আস্থার ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজ গড়ে তোলো।’
তিনি বলেন, ‘চলুন, সত্য কথাটি স্পষ্টভাবে বলি: ক্ষুধা কোনো সংকটজনিত অভাবের ফল নয়। আমরা যে অর্থনৈতিক কাঠামোর তৈরি করেছি, তার ব্যর্থতা। ২০২৪ সালে ৬৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল। অথচ আমরা প্রয়োজনের চেয়েও বেশি খাদ্য উৎপাদন করি। অর্থাৎ, এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়, আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা, নৈতিক ব্যর্থতা।’
আমাদের আরও গভীরে ভাবতে হবে এবং পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরনো পথ, যা কেবল মুনাফা বাড়ানো ব্যবসার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, তা কোটি কোটি মানুষকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। আমাদের একটি নতুন ব্যবসার ধারা প্রবর্তন করতে হবে। সেটি হচ্ছে সমাজভিত্তিক ব্যবসা, ব্যক্তিগত মুনাফাহীন ব্যবসা যা সমস্যা সৃষ্টি করে না বরং সমাধান দেয় এবং টেকসই প্রতিষ্ঠান তৈরি করে।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন অনেক সমাজভিত্তিক ব্যবসা গড়ে উঠছে, কিন্তু নীতিগত সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি ছাড়া তারা এগোতে পারছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ সময় তিন শূন্যের বিশ্ব নির্মাণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।
তিন শূন্য নীতির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূর করতে এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা সৃষ্টি যেখানে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ থাকবে না (Zero Wealth Concentration), বেকারত্বহীন সমাজ সৃষ্টির জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি (Zero Unemployment) এবং এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না (Zero Net Carbon Emissions)।
পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে বৈশ্বিক অঙ্গনে বারবার আওয়াজ তোলা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটি কোনো স্বপ্ন নয়, এটি অপরিহার্য— পৃথিবীকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সমাজভিত্তিক ব্যবসা (Social Business) হচ্ছে সেই পথ। আমরা বাংলাদেশে এর শক্তি দেখেছি। গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে— কীভাবে দরিদ্র নারীও একজন শক্তিশালী উদ্যোক্তা হতে পারেন।’
এ সময় তরুণ উদ্যোক্তা, নারী, কৃষক, কৃষিভিত্তিক উদ্যোক্তা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবকদের সহায়তায় সমাজভিত্তিক ব্যবসায়িক তহবিল গঠনের আহ্বান জানান তিনি। তার কথায়, ‘এই ধরনের উদ্যোগের পক্ষে আইনি ও আর্থিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে; বাধা নয়, সহযোগিতা করতে হবে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি হলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম। আজকের তরুণরা আগের মতো নয়— তারা সংযুক্ত, সৃজনশীল এবং তাদের এমন প্রযুক্তি হাতে রয়েছে যা ২০ বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল।
তিনি বলেন, ‘তরুণদের চাকরি খুঁজতে বলবেন না, তাদের চাকরি সৃষ্টি করতে সক্ষম করে তুলতে হবে। চলুন তাদের বলি: তোমরা চাকরিপ্রার্থী নও, চাকরিদাতা। তাদের পুঁজিতে প্রবেশাধিকার দিন; বিনিয়োগ তহবিল ও সমাজভিত্তিক ব্যবসায়িক তহবিল গড়ে তুলুন। তাদের কৃষি উদ্ভাবনকেন্দ্র গড়ে তুলতে, কৃষি প্রযুক্তি, চক্রাকার খাদ্যব্যবস্থা ও জলবায়ু-সহনশীল প্রকল্পে উদ্যোক্তা হতে সহায়তা দিন।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা যদি তরুণদের ওপর বিনিয়োগ করি, তাহলে তারা শুধু এই বিশ্বকে খাদ্যই দেবে না, বিশ্বকে বদলে দেবে।’
সূত্র: ইউএনবি
রিপোর্ট : এটিএন নিউজ/মা.ই.স